ভারতের সীমানা ঘেঁষে যশোর জেলার বেনাপোলে জন্ম মেয়েটির। শৈশব, কৈশোর কেটেছে সীমান্ত এলাকাতেই। ছোটবেলা থেকেই অদম্য মেধার অধিকারী মেয়েটি ছিল খুবই দুরন্ত স্বভাবের। সারাদিন রোদ-বৃষ্টিতে, বনে-বাঁদড়ে, মাঠে-ঘাটে খেলা করে; পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতার কেটে কাটছিল বেশ। শৈশব ছিল তার দুরন্ত, কিন্তু মায়ের মনে ছিল অঘোর চিন্তা। একদিকে মেয়ে দুরন্তপনা ছেলে স্বভাবের অন্যদিকে লেখাপড়ায় নেই মনোযোগ। উপরন্তু মেয়ের শ্যামলা বর্ণ নিয়ে মায়ের মনে কিছুটা সংশয় থাকলেও বাবার মনে ছিল মেয়েকে নিয়ে অনেক উচ্চাশা। চার ভাইবোনের মধ্যে সাবিনা বাবা-মার দ্বিতীয় সন্তান। ডাকনাম লিনা। বাবা বলত, “মেয়ে আমার ডাক্তার হবে, সে মানুষের সেবা করবে, তার জীবন এভাবেই কাটবে।” মাকে সতর্ক করে বলত, ”আমার মেয়ে খুবই মিস্টি, কোনো আজেবাজে কথা বলবে না তুমি”
সাবিনার পড়াশুনার হাতেখড়ি বেনাপোল রেসিডেন্সিয়াল প্রিক্যাডেট স্কুলে। স্কুলের শিক্ষকরা ভীষণ ভালোবাসত তাকে। মেধাবী মেয়েটি এই স্কুল থেকে দ্বিতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতে বেসরকারি বৃত্তি লাভ করে। পঞ্চম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে সরকারি বৃত্তি পায়। বড় ভাই বরিশাল ক্যাডেট কলেজে পড়ায় বাবার ইচ্ছা হল মেয়েও ক্যাডেট কলেজে পড়ুক। ষষ্ঠ শ্রেণিতে বাবার ইচ্ছাতেই মেয়ে কঠোর পরিশ্রম করে তৎকালীন মেয়েদের একমাত্র ক্যাডেট কলেজ ময়মনসিংহ ক্যাডেট কলেজে চান্সও পেল, কিন্তু বাঁধ সাধল তার মুক্তমনা স্বাধীন চেতা স্বভাব। শৃঙ্খলার বেড়াজাল থেকে মুক্ত স্বাধীন চেতা দুরন্তপনা এই মেয়েটি পড়বে না ক্যাডেট কলেজের শৃঙ্খলা ঘেরা পরিবেশে। প্রথমবারের মত বাবার মন ভেঙ্গে গেল, কিন্তু মেয়েটি কথা দিল সে ভবিষ্যতে বাবার মুখ উজ্জ্বল করবে। সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হল বেনাপোল বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। মেয়েটি বাবার কথা রেখে অষ্টম শ্রেণিতে থানার মধ্যে ফাস্ট হয়ে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেল, আর পিছু তাকাতে হয়নি তাকে। মাধ্যমিকে পেল সিজিপিএ “৫”। বোর্ড বৃত্তি নিয়ে ভর্তি হলো দেশের অন্যতম বিদ্যাপীঠ যশোর ক্যান্টনমেন্ট কলেজে। কলেজ শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলো! মেডিকেলে চান্স না পাওয়ায় মেয়েকে ডাক্তার বানানোর স্বপ্ন ভঙ্গ হলো বাবার। কিন্তু এই মেয়েটি চেয়েছিল সে তার জীবনকে উপভোগ করে স্বাধীনভাবে পড়াশোনা করবে, আর তার স্বপ্ন ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। অবশেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ থেকে প্লেস করে ফার্স্ট ক্লাস নিয়ে অনার্স সম্পন্ন করলো।
এরপর হলের সকলের মত সেও বিসিএস নিয়ে ব্যস্ত, তাঁর মনেও বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন উঁকি দিল। বিসিএস এর পড়াশোনা সেভাবে না করলেও তাঁর ছিল প্রচণ্ড মনোবল। আর তারই ফলশ্রুতিতে ৩৩তম বিসিএস প্রিলিতে সে টিকেও গেল। মাস্টার্স এর রেজাল্টের ক্ষতি হবে ভেবে বিসিএস লিখিত পরীক্ষাতে সে অংশগ্রহণ করতে চাইলনা। ভাগ্যক্রমে লিখিত পরীক্ষার আগের রাতে জানা গেল “পরীক্ষা স্থগিত”। অতঃপর পরবর্তী তারিখে মাস্টার্স পরীক্ষা ও টিউশনির ফাঁকে ফাঁকে মিশুক এই মেয়েটি বন্ধু বান্ধবের অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতায় লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করলে তুলনামূলক কম প্রস্তুতি নিয়ে বিসিএস-এর লিখিত পরীক্ষায় অনেক ভালো করল। সেই সাথে মাস্টাসের্র রেজাল্টও ভালো হলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কুয়েত মৈত্রী হলে থেকে থিসিস করার পাশাপাশি ৩৪ এর প্রিলিতেও সে উত্তীর্ণ হলো!
এর মাঝে পরিবারে নেমে আসল ঘোর বিষাদ। ছোট ভাই অষ্টম শ্রেণিতে পড়া কালীন হলো ওপেন হার্ট সার্জারি। সব কিছু ছেড়ে সে চলে আসল গ্রামের বাড়ি। অসুস্থ ভাইয়ের সেবা যত্ন ও পড়াশোনার দায়িত্ব নিল পরিবারের বড় এই মেয়েটি। এদিকে বাবা ঋণগ্রস্থ হয়ে দিশেহারা। বারো বছর আগের ঋণের দায়ে একমাত্র আশ্রয় স্থল বাড়িটি ক্রোক করার নির্দেশ দিয়েছে আদালত। চার দিকে শুধু বিপদ আর বিপদ। ছোট বেলার উড়নচণ্ডী সেই মেয়েটিই নিল পরিবারের সকল দায়িত্ব। কিছু ধানি জমি বিক্রি করে ব্যাংক থেকে বাড়ি ছাড়াল, দিনরাত পরিশ্রম করে ছোট ভাইকে পড়াশোনা করাল। এই ছোট ভাই জেএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে পেয়ে গেল গোল্ডেন “এ প্লাস”।
সে যখন এসব নিয়ে মহাব্যস্ত, রেজাল্ট হল ৩৩-এর ভাইভার। বিধাতা নিজ হাতেই তাকে করে দিল বাংলাদেশ পুলিশের গর্বিত সদস্য হওয়ার সুযোগ। রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ের পুলিশে যোগদান করা নিয়ে কিছুটা সংশয় থাকলেও কেউ কোনো আপত্তি করল না। ২০১৪ সালে পুলিশের ট্রেনিং যখন শুরু হল, দৌড়ছুটে পারদর্শী এই মেয়েটি কল্পনাতেও ভাবেনি হাত পা ভাঙার ফলে ট্রেনিংটি শারীরিক ও মানসিক দিক দিয়ে এতটা ভীতিকর হয়ে উঠবে। অবশেষে পুলিশ একাডেমি সারদার ওস্তাদজীদের অনুপ্রেরণা, বাব-মার দোয়া আর আল্লাহর অশেষ রহমতে ট্রেনিং ছেড়ে চলে আসতে চাওয়া মেয়েটি ট্রেনিং সম্পন্ন করে খুলনা জেলায় শিক্ষানবিশ হিসেবে যোগদান করে। ২০১৬ সালে থানায় বাস্তব প্রশিক্ষণকালীন সাবিনার বিয়ে হয় ৩৩ তম বিসিএস এর শিক্ষা ক্যাডার এর এক ছেলের সাথে। নিজেদের বুঝাপড়া থেকে একবার দেখা করার পরেই তাদের বিয়ে হয়। মেয়ের পড়াশোনা নিয়ে বাবা মাকে কখনো যেমন “পড়ো” এ কথাটি বলতে হয়নি ঠিক একই ভাবে বিয়ে নিয়েও করতে হলো না কোনো চিন্তা বা খরচ। বিয়ের দুই মাস পর বাচ্চা কনসিভ করে স্বামীর পোস্টিং বগুড়া আজিজুল হক কলেজ হওয়ার সুবাদে তার প্রথম পোস্টিংটি হয় ৪ এপিবিএন বগুড়া। সেখানে অত্যন্ত পেশাদারিত্বের সাথে কাজ করায় অল্প সময়ের মধ্যে কর্মস্থলে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। ইতোমধ্যে সে এক বছরের বাচ্চা নিয়ে ঢাকার সাভারে ফাউন্ডডেশন ট্রেনিং সম্পন্ন করে কর্মস্থলে যোগদান করে, কিন্তু সে চাইল পুলিশ এর মূলধারা অর্থাৎ ক্রাইমে কাজ করতে। পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে গিয়ে সে নিজে জানাল, সে ক্রাইম জোনে কাজ করতে চায়। কিন্তু সিনিয়ররা চিন্তিত হলেন বগুড়ার মত জায়গাতে সার্কেল তথা মাঠ পর্যায়ে মেয়েদের কাজ করাটা অত্যন্ত কঠিন হবে। বিশেষ করে এক বছরের ছোট বাচ্চা যার আছে! কিন্তু সে স্যারদের কথা দিল, সে অবশ্যই পারবে। অবশেষে অদম্য ইচ্ছা নিয়ে তার পোস্টিং হল বগুড়া জেলার গাবতলী সার্কেল।
গাবতলী ও সারিয়াকান্দি থানা নিয়ে গঠিত গাবতলী সার্কেল। ২০১৯-২০২১ সালে রাজশাহী রেঞ্জের ৮টি জেলার মধ্যে একমাত্র লেডি সার্কেল এএসপি হিসেবে সে কর্মরত ছিল। প্রথমে মনের মধ্যে একটু ভয় কাজ করছিল। যেহেতু গাবতলী সার্কেল ছিল রাজনৈতিক (তারেক জিয়ার বাড়ি) ও ভৌগোলিক ভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আলী আশরাফ ভূঞার মত অদম্য মেধাবী ও নেতৃত্বের অধিকারী এসপির অধীনে তাকে একবারও পিছু তাকাতে হয়নি।
অদম্য গতিতে সে ছুটে চলে দুর্গম সব ঘটনাস্থলে। বিশেষ করে সারিয়াকান্দি থানার দুর্গম চর গুলিতে জনমানুষের সাথে মিশে গিয়ে অসংখ্য লোমহর্ষক মামলার রহস্য উদ্ঘাটন, মানুষকে ন্যায় বিচার পাইয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা, দিনরাত পরিশ্রম করে স্কুল কলেজে গিয়ে উঠতি বয়সী ছেলে-মেয়েদের সচেতন করে সাবিনা নামটি হয়ে উঠে গাবতলী ও সারিয়াকান্দি থানার সাধারণ মানুষের কাছে আস্থার প্রতীক। ধর্ষণ হওয়া ছোট শিশুটির কাছে সে যেমন ছিলেন মমতাময়ী মা, অপরদিকে চোর ডাকাত কিংবা অন্যায়কারীর জন্য সে ছিল যমদূত। ২০১৯ সালে নারী শিশু হেল্প ডেস্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে বগুড়া জেলা মডেল হয়।
তৎকালীন বগুড়া জেলার এসপির নির্দেশনায় সাবিনা ইয়াসমিন সার্কেলের অতিরিক্ত কাজ হিসেবে সকল থানাতে নারী শিশু হেল্প ডেস্ক স্থাপন, প্রোমটিং ও জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রত্যেক থানার প্রত্যন্ত অঞ্চলে জনসচেতনতামূলক প্রোগ্রাম পরিচালনা করে বগুড়া জেলার সাধারণ মেয়েদের কাছে অল্প সময়ে হয়ে উঠে আদর্শ। নির্যাতিত নারী ও শিশুদের নিয়ে কাজ করাই তৎকালীন ইন্সপেক্টর জেনারেল ড. জাবেদ পাটোয়ারীর কাছ থেকে পায় স্বীকৃতি।
সততা, কর্মদক্ষতা, মেধা ও পেশাদারিত্বের স্বাক্ষর রেখে অসংখ্যবার পেয়েছে শ্রেষ্ঠ সার্কেল এএসপির পুরস্কার। অতঃপর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে পদোন্নতি নিয়ে যায় নওগাঁ জেলা। কাজ যেন তার পিছু ছাড়ে না। সেখানে সে দায়িত্ব পায় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সদর এর পাশাপাশি অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল), অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ট্রাফিক) এবং তৎকালীন নওগাঁয় বহুল আলোচিত পুলিশ শপিং মলের সমস্ত কাজের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে অর্থাৎ সদস্য সচিব হিসেবে। দিনরাত পরিশ্রম করে নওগাঁ জেলার তৎকালীন এসপি প্রকৌশলী জনাব আবদুল মান্নান মিয়ার নেতৃত্বে স্বল্পতম সময়ে কাজ শেষ করায় সে সময়ের বাংলাদেশ পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল ড. বেনজীর আহমেদ নিজে এসে শপিং মল উদ্বোধন করেন।
প্রায় ২ বছর নওগাঁ জেলা পুলিশে কাজ করার পর দ্বিতীয় বার মা হলে সে আবারও পোস্টিং নেয় ৪ এপিবিএন, বগুড়া। সেখানে সে দায়িত্ব পায় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বিকিউএম হিসাবে, আর তার একমাস পর সেখানে শুরু হয় টিআরসির(কনস্টেবল) ট্রেনিং। ৪ এপিবিএন এর তৎকালীন অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি জনাব সৈয়দ আবু সায়েম ইতোমধ্যে তাঁর দক্ষতাকে উপলব্ধি করে দায়িত্ব দেয় টিআরসির ট্রেনিংয়ের কোর্স কো-অর্ডিনেটর হিসাবে। এপিবিএন-এর অপারেশনাল ইউনিটে অভিযান পরিচালনা করা, স্কুল কলেজে সচেতনতামূলক প্রোগ্রাম করে সেখানকার সাইবার ক্রাইম সেলকে শক্তিশালী করা, দীর্ঘ ৬ মাস টিআরসির মাঠ কার্যক্রম ও আইন অনুশীলন কাছ থেকে তদারকি করে পরিচয় দিয়েছে সঠিক নেতৃত্বের। বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজনবিহীন প্রশিক্ষণের কঠিন সময়ে প্রশিক্ষণার্থীদের কাছে সাবিনা ইয়াসমিন ছিল সত্যিকারের অভিভাবক। ইতোমধ্যে তাঁর পোস্টিং হয় আরএমপি, রাজশাহীতে।
অত্যন্ত সাধারণ ঘর থেকে উঠে আসা মেয়েটির বাবার ছিল একটি ওষুধের ফার্মেসি আর মা গৃহিণী। ফার্মেসি থাকার সুবাদে কিছু প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান করায় গ্রামের লোক সাবিনার বাবাকে ডাক্তার বলে ডাকত। যে মেয়েটি একদিন পরিচিত হত বাবার পরিচয়ে, কালাম ডাক্তারের মেয়ে হিসেবে, বাবার মৃত্যুর আগে সেই মেয়েই তার বাবাকে গর্ববোধ করাতে পেরেছিল। তার বাবা বলেছিল, “আজকে সবাই তাকে বলে এএসপির বাবা” মেয়ের পরিচয়ে পরিচিত হতে পেরে ভীষণ গর্ব অনুভব করেন তিনি। বাবার মৃত্যুর পর এই মেয়েটি তার ছোট ভাই বোনের পড়াশুনা থেকে শুরু করে পরিবারের সমস্ত দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেয়।
বর্তমানে সে আরএমপিতে এডিসি ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনে দায়িত্বরত থাকলেও অতিরিক্ত দায়িত্বে রয়েছে এডিসি ফোর্স, এডিসি প্রসিকিউশন, এডিসি এস্টেট অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট।
এভাবেই সাবিনারা ঘর-সংসার, বাচ্চা সামলিয়ে সমস্ত প্রতিকূলতাকে ছাপিয়ে কর্মস্থলে নিজ দায়িত্বের পাশাপাশি অনেক অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করে প্রতিনিয়ত প্রমাণ করে দিচ্ছে।
“আমরা নারী, আমরাও পারি”