বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলসহ সারা দেশেই হঠাৎ করে জেঁকে বসেছে শীত। ঘনকুয়াশা ও শৈত্য প্রবাহের প্রকোটও বাড়ছে। শীতের এই সময়ে প্রায় সব বয়সের মানুষেরাই কিছু শীতকালিন রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী শীতের প্রভাবজণিত রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতিনিয়ত হাসপাতালেও বাড়ছে ভর্তি রোগীর সংখ্যা।
শীতের এই প্রভাব থেকে বাদ পড়েনি শিশুরাও। যার দরুন নানাধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা।
শিশু বিশেষজ্ঞগণ বলেন, শীতের সময় দেখা যায় যে, শিশুরা প্রয়োজনীয় পোশাক ঠিকমতো পরতে চায়না। হাত ও কান খোলা থাকে, ঠান্ডা পানি পান করে যার কারণে তাদের শরীরের তাপমাত্রার ভারসাম্য নষ্ট হয়। শিশুরা এ সময় ঠান্ডা পানি ও ঠান্ডা বাতাসের সাথে খাপ খাওয়াতে পারেনা। ফলে তারা প্রায়শই রোগক্রান্ত হয়ে পড়ে।
শীতের সময় বাতাসে জীবানু বেশি থাকে। বিশেষ করে কিছু ভাইরাস থাকে যেগুলোর রোগ তৈরী করার প্রবনতা শীতকালে বৃদ্ধি পায়। এই সকল ভাইরাস শ্বাসনালীর মাধ্যমে দেহে প্রবেশ করে ইনফ্লুয়েঞ্জা (সর্দি, কাশি, মাথাব্যথা), মামস, টনসিল ফুলে যাওয়ার মতো রোগের সৃষ্টি করে।
এই সময় লক্ষনীয় আরেকটি বিষয় হলো বড়দের ইনফ্লুয়েঞ্জা জণিত সমস্যা থেকে শিশুদের মাঝেও তা ছড়িয়ে পড়ে (যেমন- শিশুদের সামনে হাঁচি বা কাশি দেওয়ার মাধ্যমে)। ফলে শিশুরা সামান্য শীতের প্রভাবেও তীব্র অসুস্থ হয়ে যায়।
শীতকালে বাইরের খোলা খাবার শীতকালীন রোগের আরেকটি অন্যতম কারণ। যেমন-ফুচকা, চটপটি, বাইরের পানি, চা-সহ নানান চটকদার খাবার, যে সবের মাধ্যমে প্রচুর পরিমাণে জীবানু ছড়িয়ে পড়ে। ফলে খাদ্য বিষক্রিয়া দেখা দেয়।
শীতের সময় এই রোগগুলো বেশি হয় কারণ কিছু কিছু জীবানু এই শীতের সময়েই কয়েকগুন শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং বাতাস ও খাবারের সাথে মানুষের শরীরে আক্রমন করে। ফলে শ্বাসপ্রশ্বাসের এবং পেটের নানান রোগ তৈরী হয়।
অন্যান্য সময়ের তুলনায় শীতকালে বাতাসে ধুলার পরিমাণও বেশি থাকে। এ সময় বৃষ্টি কম হয় বলে বাতাসের ধুলা ও অন্যান্য উপাদান ঝরে পড়েনা । ফলে রোগ আক্রান্ত হওয়ার আশংকা বেড়ে যায়।
কী কী রোগ হয় :
শিশু বিশেষজ্ঞগণ বলেন, শীতের মৌসুমে সকল বয়সের শিশুদের সাধারনত সর্দি, ঠান্ডা, কানের সমস্যা, নাকে পানি পড়া, হাঁচি-কাশি, বমি, পেটের সমস্যাসহ ভাইরাস জনিত নানান রোগ বেশি দেখা দেয়।
নবজাতকদের ক্ষেত্রে এসময় ডায়রিয়া ও জ্বর দেখা দিতে পারে। শীতকালে ছয় মাসের কম বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে রোটা ভাইরাস জণিত ডায়রিয়ার প্রবণতা বেশি দেখা দেয়। এছাড়াও যেসব রোগ দেখা যায় সেগুলো হলো-
নিউমোনিয়া ;
ডায়রিয়া ;
গ্যাসট্রো এনটেরাইটিস বা খাবারে বিষক্রিয়া ;
অ্যাজমা- যা আগে থেকে থাকলে এসময় সেটা আবার বৃদ্ধি পায় ;
টসসিলাইটিস ;
প্যারোটাইটিস বা মামস ;
ইনফ্লুয়েঞ্জা ;
যেসব শিশুর এ্যালার্জি থাকে তাদের শ্বাসকষ্ট হয়।
তারা বলছেন, বাবা-মা বা স্বজনদের খেয়াল রাখতে হবে যেন শিশু কোনভাবেই ঠান্ডা না লাগিয়ে ফেলে ।
এ বিষয়ে তারা কিছু সতর্কতা অবলম্বন করার পরামর্শ দিয়েছেন। এগুলো হলো-
১. শিশুদের শরীর সবসময় গরম রাখতে হবে। ঘরের পরিবেশ যেন গরম থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
২ শিশুদের পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। শিশুদের ঠান্ডা লেগে গেলে অনেক সময় শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। এসময় লক্ষ্য রাখতে হবে যেন নাক বন্ধ হয়ে না থাকে। তাই সর্বদা নাক মুখ ভালভাবে পরিস্কার রাখতে হবে।
৩. একটি বাচ্চা অসুস্থ হলে তার থেকে যেন অন্য বাচ্চাদের মাঝে জীবানু না ছড়ায় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
৪. এছাড়া পরিবারের অন্যরা আক্রান্ত হলে শিশুদের সামনে আসার সময় অবশ্যই মাস্ক পরিধান করতে হবে অথবা শিশুদের থেকে দুরত্ব বজায় রাখতে হবে। শিশুদের গোসলের সময় উষ্ণ গরম পানি ব্যবহার করতে হবে।
৫.বাচ্চারা বাইরে বের হলে পুরো শরীরের সাথে সাথে কানও ঢাকতে হবে। মাথায় গরমটুপি, হাত ও পা মোজা মাস্ক পড়তে হবে যাতে বাতাস না লাগে।
৬. বাইরের অস্বাস্থ্যকর খোলা খাবার খাওয়ানো যাবেনা।
৭.বাচ্চাদের সামনে ধুমপান করা উটিত নয়। এতে অ্যাজমার সহিত শ^াসকষ্ট জণিত সমস্যা বেড়ে যাওয়ার আশংকা বেশী থাকে।
৮. ঠান্ডা জাতীয় খাবার যেমন আইসক্রিম, কোমল পানীয় এগুলো এড়িয়ে চলতে হবে।
কখন চিকিৎসকের কাছে নিবেন ?
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণ বলেন, কিছ ুকিছু সময়ে দেখা যায় যে, সর্দি বা ঠান্ডা লাগলে তার জন্য বাসায় কিছু ব্যবস্থা নিলে সেরে যায়। আবার অনেক সময় এগুলো সহজে ভাল হতে চায় না ;
শিশুদের মধ্যে কিছু নির্দিষ্ট ধরণের লক্ষণ দেখা দিলে তাদেরকে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন করতে হবে। সেগুলো হলো-
শিশু যদি খাওয়া কমিয়ে দেয় ;
যদি প্রস্রাব কমে যায় ;
ত্বকে বা অন্য কোথাও ফোসকা পড়া বা অন্য কোন চর্মোরোগ দেখা দিলে ;
বাচ্চার ডায়রিয়া এবং পানি শূন্যতা দেখা দিলে ;
উচ্চ মাত্রায় জ্বর হলে অর্থাৎ তাপমাত্রা যদি ১০০ বা ১০১ ডিগ্রী সেঃ এর বেশি থাকে ;
শ্বাসকষ্ট জণিত কারণে বাচ্চা ঘুমাতে না পারলে ;
অতিরিক্ত বমি করলে ;
বাচ্চা যদি নেতিয়ে পড়ে বা দুর্বল হয়ে যায় ;
বাচ্চা মায়ের বুকের দুধ টেনে খেতে না পারলে ;
বাচ্চার যে কোন কারণে খিচুনি হলে ;
এসব লক্ষণ দেখা দিলে বাচ্চা কোন ভাবেই বাসায় রাখা যাবেনা। সাথে সাথে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
হোম রেমেডি কী ?
শীতকালিন সমস্যার জন্য পূর্বে সরিষার তেল ও রসুন গরম করে বাচ্চাদের শরীরে মালিশ করার যে প্রচলন ছিল সেটি ব্যবহার না করার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞ চিসিৎসকগণ ;
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগন বলেন, সরিষার তেল ব্যবহার করলে শিশুদের ত্বকে ডার্মাটাইটিস বা ত্বকের বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণ দেখা দিতে পারে। তাই এটি ব্যবহার না করাই উত্তম ;
শীতকালে শিশুদের যদি হালকা ঠান্ডা বা সর্দি লাগে সেক্ষেত্রে ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ানো যেতে পারে। সর্দি-কাশিকে দূরে রাখতে বাসায় থেকে যেসব পদক্ষেপ নেয়া যায় তা হলো-
বাচ্চাদের লেবুর সরবত গরম পানি দিয়ে পান করানো যেতে পারে। এতে সর্দি ঠান্ডা ভাল হয় ;
শিশুদের তরল এবং গরম খাবার দিতে হবে ;
সর্দি-ঠান্ডা হলে আদা বা মধু দিয়ে বিভিন্ন ফলের রস করে খাওয়ানো যেতে পারে ;
তুলসী পাতা, লং, এলাচ দিয়ে কুসুম-কুসুম গরম পানি পান করালে সর্দি ও ঠান্ডায় বাচ্চারা অনেক আরাম পায় ;
ঠান্ডা বা গলা ব্যাথা হলে গরম পানিতে লবন দিয়ে নিয়মিত গড়গড়া করানো যেতে পারে ;
নবজাতকদের যতন কেমন হবে ?
পূর্বের সময়ের আতুর ঘরের মতো এখনো নবজাতকদের একটু আলাদা করে রেখে বাড়তি যতন নেওয়ার কথা বলেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণ ;
নবজাতকদের গরম এবং জীবানুমুক্ত পরিবেশে অবশ্যই রাখতে হবে ;
যেসব শিশু অপরিপক্ক (প্রি-ম্যাচিউর) অবস্থায় জন্ম নেয় তাদের আরো বেশি খেয়াল রাখতে হবে ;
বিশেসজ্ঞ চিকিৎসকগণ বলেন, এসব শিশু সূর্যালোকে কম থাকে বলে তাদেরকে দিনের নির্দিষ্ট একটি সময় রোদে রাখতে হবে; তবে খেয়াল রাখতে হবে নবজাতক শিশু যেন হলুদ হয়ে না যায়। সর্বোপরি নবজাতকদেরকে অবশ্যই মায়ের বুকের দুধ পান করানোর প্রতি জোর দিতে হবে।
ডা. শামসুদ্দিন আহমেদ রুবেল
সহকারী সার্জন
বিভাগীয় পুলিশ হাসপাতাল
রাজশাহী।