দ্বাদশ সংসদের সামনে তিন চ্যালেঞ্জ
প্রথম অধিবেশনেই স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার নির্বাচনসহ সংসদীয় কমিটি গঠন * সংসদীয় কমিটিগুলোকে শক্তিশালী করার দাবি * শূন্যস্থান পূরণ করবেন কারা
বিরোধী দলের সক্রিয় অংশগ্রহণ, সংসদ এবং সংসদীয় কমিটিগুলোকে কার্যকর করার মতো তিন চ্যালেঞ্জ নিয়ে শুরু হচ্ছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন। আজ মঙ্গলবার বেলা ৩টায় ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকুর সভাপতিত্বে অধিবেশনের কার্যক্রম শুরু হবে। অধিবেশনের শুরুতেই স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগের সংসদীয় দল ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এবং অ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকুকে দ্বিতীয় মেয়াদেও স্পিকার এবং ডেপুটি স্পিকার পদে পুনর্নির্বাচিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ দুজনের নির্বাচন প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর জাতীয় সংসদে শোকপ্রস্তাব উত্থাপন ও গ্রহণ করা হবে। পরে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা মেনে বছরের প্রথম এবং নতুন অধিবেশন হওয়ায় সংসদে ভাষণ দেবেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। পরে তার দেওয়া ভাষণের ওপর ধন্যবাদ প্রস্তাব উত্থাপন করা হবে। নতুন সংসদের সংসদ-সদস্যরা এই প্রস্তাবের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নেবেন।
এ ছাড়া অধিবেশনের শুরুতে স্বাগত বক্তব্য দেওয়ার কথা রয়েছে ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকুর। উদ্বোধনী ভাষণে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন আওয়ামী লীগ সরকারের সফলতা এবং আগামীতে করণীয় বিষয়ে দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য রাখবেন। এই অধিবেশনে ৫০টি সংরক্ষিত নারী আসনের নির্বাচন, সংসদীয় কমিটি গঠনের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিল পাশ হওয়ার কথা রয়েছে।
এছাড়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদের কার্য উপদেষ্টা কমিটিসহ বেশ কয়েকটি কমিটি গঠন করা হবে প্রথম দিনই। বিএনপি-জামায়াতসহ তাদের বলয়ভুক্ত দল ও জোটের বর্জনের মধ্যে ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ২২৩টি আসনে জয়ী হয়ে টানা চতুর্থবার সরকার গঠন করে।
জিএম কাদেরের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি ১১টি আসন নিয়ে টানা তৃতীয়বার জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দলের আসনে বসে। এছাড়া ৬২টি আসনে জয়ী হন স্বতন্ত্র সংসদ-সদস্যরা। এবারের এ নির্বাচনে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ এবং বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি একটি করে আসন পায়।
জাতীয় পার্টি না স্বতন্ত্র জোট- কারা হবে দ্বাদশ সংসদের বিরোধী দল, এ নিয়ে চলমান বিতর্কের মধ্যে নির্বাচনে আসন পাওয়া দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসাবে জাতীয় পার্টিকে রোববার বিরোধী দলের মর্যাদা দেন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের এমপি দ্বাদশ জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা এবং একই দলের সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এমপি বিরোধীদলীয় উপনেতা হিসাবে দায়িত্ব পালন করবেন। বিরোধীদলীয় চিফ হুইপের দায়িত্ব পালন করবেন জাতীয় পার্টির মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু এমপি। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের এমপি একাদশ জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতার দায়িত্ব পালন করেন।
পাঁচ বছর মেয়াদের এই সংসদে বিরোধী দলের সদস্য মাত্র ১১ জন। স্বতন্ত্র সংসদ-সদস্যরা সংখ্যায় ৬২ জন হলেও তারা থাকতে চান সরকারি দলের ছায়ায়। এর বাইরে শাসক দল আওয়ামী লীগের আছে ২২৩ জন সংসদ-সদস্য।
এ পরিস্থিতিতে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি কতটা ভূমিকা পালন করতে পারবে, সংসদ কতটা কার্যকর এবং গতিশীল হবে-এমন চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে বসতে যাচ্ছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ। একাদশ জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ২৬ জন (সংরক্ষিত ৪টিসহ) নিয়েই সংসদে নানা ইস্যুতে বেশ সরব ও সোচ্চার ছিল।
দলটির একাধিক অভিজ্ঞ সংসদ-সদস্য এবারের দ্বাদশ জাতীয় সংসদে নেই। তাদের এই শূন্যস্থান পূরণ করবেন কারা-এ নিয়েও আলোচনা রয়েছে। পাশাপাশি ছায়াসরকার বলে বিবেচিত সংসদীয় কমিটিগুলোকে শক্তিশালী করার দাবি দীর্ঘদিনের। সংবিধান বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সংসদীয় কমিটি যত শক্তিশালী ও কার্যকর হবে, তত সুফল ঘরে তুলতে পারবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ।
জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার সোমবার যুগান্তরকে বলেন, নতুন সংসদ বসতে যাচ্ছে। বিএনপিসহ তাদের বলয়ে থাকা অনেক রাজনৈতিক দল এবারের নির্বাচনে অংশ নেয়নি। তার পরও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নতুন সংসদও যথারীতি বসতে যাচ্ছে।
এখন দেখার বিষয় এই সংসদ কতটা কার্যকর হয়। সংসদ কার্যকর করাটাই বড় চ্যালেঞ্জ বলে আমি মনে করি। মাত্র ১১ জন সংসদ-সদস্য নিয়ে বিরোধী দল কতটা কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারবে-তাও দেখার বিষয়। তিনি আরও বলেন, আরও একটি বড় চ্যালেঞ্জ সংসদীয় কমিটিগুলোকে শক্তিশালী এবং কার্যকর করা। কমিটির সুপারিশ যাতে মন্ত্রণালয় আমলে নিতে বাধ্য হয়-এমন আইন করা গেলে সংসদীয় কমিটিগুলো কার্যকর হবে।
ইতোমধ্যে জাতীয় পার্টির সদস্যরা সংসদে কার্যকর বিরোধী দলের ভূমিকা পালনের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। অধিবেশনের প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাইলে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ ও জাতীয় পার্টির মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু এমপি সোমবার যুগান্তরকে বলেন, সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দলের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব রয়েছে। সেই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনে আমরা প্রস্তুত। অতীতের মতো এবারও সরকারের ইতিবাচক কর্মসূচিতে সহযোগিতা এবং নেতিবাচক পদক্ষেপ নিয়ে সমালোচনার মাধ্যমে জনগণের স্বার্থরক্ষায় জাতীয় সংসদে বিরোধী দল যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করবে জাতীয় পার্টির সংসদ-সদস্যরা।
সংসদ সচিবালয় সূত্রে জানা যায়, ইতোমধ্যে অধিবেশনের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে সংসদ সচিবালয়। সংসদ ভবন এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। প্রথম দিনে দর্শনার্থীদের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। সংসদ ভবন এলাকায় সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অধিবেশন কেন্দ্র করে সংসদ ভবনজুড়ে উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে।
নতুন সংসদের প্রথম দিনের অধিবেশনে প্রধান বিচারপতি, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টারা, দেশি-বিদেশি কূটনীতিক, রাজনৈতিক নেতা, সরকারি কর্মকর্তা এবং ভিআইপিদের আত্মীয়স্বজনসহ পাঁচ শতাধিক অতিথি উপস্থিত থাকবেন। ইতোমধ্যে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্র্রী কার্যালয় এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে সংগৃহীত তালিকা চূড়ান্ত করে আমন্ত্রণপত্র বিতরণ করা হয়েছে। আমন্ত্রণপত্র ছাড়া কোনো অতিথি ওইদিন সংসদে প্রবেশ করতে পারবেন না বলে সংসদের নিরাপত্তা বিভাগ থেকে জানানো হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, অধিবেশন সামনে রেখে নিরাপত্তাব্যবস্থাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এজন্য সংসদের ট্যানেল ও ড্রাইভওয়েতে যে কোনো ধরনের গাড়ি রাখা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নিরাপত্তার স্বার্থে দর্শনার্থীদের মোবাইল বাইরে রেখে প্রবেশ করতে বলা হয়েছে। এছাড়া প্রত্যেকটি মোবাইল বিশেষভাবে পরীক্ষার জন্যও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সংসদের অধিবেশন কক্ষে সংসদ-সদস্যদের বসার চেয়ার ঠিক আছে কিনা তা পরীক্ষা করা হয়েছে।
অধিবেশন কক্ষের সব মাইক্রোফোন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। অধিবেশন চলাকালে সব লিফট ত্রুটিমুক্ত রাখতে বলা হয়েছে। ইতোমধ্যে সংসদ ভবন ফুলসহ বিভিন্ন গাছ দিয়ে সাজানো হয়েছে। অধিবেশন চলাকালে অক্সিজেন সুবিধাসহ সার্বক্ষণিক একটি অ্যাম্বুলেন্স রাখতে বলা হয়েছে। সংসদ লবিতে একজন ডাক্তারসহ প্রয়োজনীয় সামগ্রী থাকবে। এছাড়া সংসদ অধিবেশন ও সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক সম্পর্কে অবহিত করতে সংসদ-সদস্যদের জন্য ‘শর্ট ম্যাসেজ সার্ভিস’ চালু করা হয়েছে।
অধিবেশন কক্ষের আসন বিন্যাসের কাজও শেষ। স্পিকারের আসনের ডানদিকে ট্রেজারি বেঞ্চের সামনের সারিতে থাকছে সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন। পরের আসনে সংসদ উপনেতা মতিয়া চৌধুরী; তাদের পাশের আসনে বসবেন শেখ ফজলুল করিম সেলিম। প্রথম সারিতে আসন আছে আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন ও কৃষিমন্ত্রী উপাধ্যক্ষ আবদুস শহীদের। সংসদ নেতার পেছনের সারির প্রথম আসন চিফ হুইপ নুর-ই-আলম চৌধুরীর।
স্পিকারের বাঁদিকে সামনের সারিতে বসবেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় নেতা জিএম কাদের, পরের আসনে বিরোধীদলীয় উপনেতা ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান রুহুল আমিন হাওলাদার। দ্বিতীয় সারিতে দলটির মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু। এছাড়া বিরোধী দলের প্রথম সারির পরের তিনটি আসন বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে স্বতন্ত্র সংসদ-সদস্য আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, কল্যাণ পার্টির মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম এবং বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননকে।
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক।